নবকুমার:
বাঙালির ইতিহাসে বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় ১৫ আগস্ট। এটি বাঙালি জাতির শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল চক্রান্তকারী ও উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা লোভী হায়েনার দলের নির্মম বুলেটের আঘাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। ’ মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার। এই মুক্তিযোদ্ধাকে বঙ্গবন্ধু সেনা প্রধান করেছিলেন। কিন্তু শফিউল্লাহ যে ভীতু এবং অবিশ্বাস্য রকমের স্বার্থপর, তা বঙ্গবন্ধু জানতেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা প্রধান শফিউল্লাহ নির্বিকার থেকেছেন। তার অধীনের সেনাবাহিনীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। বলা হয় পুরো হত্যা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ৪০০ সেনা সদস্য জড়িত ছিলেন। তখন সেনাবাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫৮ হাজার। ৫৭ হাজার ৬০০ সেনা সদস্য তখন কী করেছিলেন?
সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কী করেছিলেন? তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন! আর এখন বলছেন, ‘আমার হাত-পা বাঁধা ছিল’। কে বেঁধেছিল আপনার হাত-পা? জাতির জনককে হত্যা করা হচ্ছে, আপনি জানছেন, কিন্তু কিছু করছেন না! আপনার কমান্ডে ৫৭ হাজার ৬০০ সেনা সদস্য! এখন দাবি করছেন আপনার কমান্ড জিয়াউর রহমান শোনেননি, খালেদ মোশাররফ
শোনেননি! অধীনস্ত কেউ আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, অথচ আপনি সেনাপ্রধান! অনেকে শফিউল্লাহকে বুদ্ধিহীন বা বোকা বলেন। মোটেও তা ঠিক নয়। বুদ্ধিহীন বা বোকা হলে, সৈনিকদের নিয়ে নিজে ৩২ নম্বর ছুটে যেতেন, যাওয়ার চেষ্টা করতেন। হয় সফল হতেন অথবা নিজেও নিহত হতেন। শফিউল্লাহ চতুর-ধুরন্ধর। তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপদে দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি যে বুদ্ধিহীন বেকুব নন, পরবর্তী কর্মকান্ডে তার প্রমাণ রয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করে সুবিধা ভোগ করেছে ,তাদের থেকে শফিউল্লাহ ততটাই সুবিধা নিয়েছেন, যতটা নেওয়া যায়। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের থেকে রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরে রেখে শফিউল্লাহ আনুগত্য প্রকাশ করেছেন খন্দকার মোশতাকের প্রতি। রেডিওতে ভাষণ দিয়ে খুনি মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে। তার থেকে সুবিধা নিয়েছেন। সুবিধা নিয়েছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ সরকারের থেকেও। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করেছেন। শফিউল্লাহকেও সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রদূত করেছেন। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ফারুক-রশীদদের দেশে নিয়ে এসেছে। তাদের দিয়ে ফ্রিডম পার্টি করিয়েছেন।
ফারুক-রশীদ ঢাকা শহরের মাস্তান-সন্ত্রাসীদের দলে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা নির্যাতন করিয়েছেন। সেই এরশাদের সুবিধা নিয়ে শফিউল্লাহ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের যেমন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে, শফিউল্লাহকেও পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে।হত্যাকারীদের চেয়েও বেশি ঘৃণা প্রাপ্য শফিউল্লাহর। ‘আমার হাত-পা বাঁধা ছিল’-এসব কথা একজন সেনাপ্রধানের মুখে মানায় না। তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
শেখ ফজলুল হক মণি (শেখ সেলিমের বড় ভাই শেখ ফজলুল হক মণি) মারা যাওয়ার দেড়-দুই ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধুকে মারা হয়।,রাত ২টার দিকে জেনারেল সফিউল্লাহকে কিছু সেনা সদস্যের সন্দেহজনক গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
মণি মারা যাওয়ার দেড়-দুই ঘণ্টার পর বঙ্গবন্ধু মারা গেল। কেউ বলে ৬টা ৪৭ মিনিট। বঙ্গবন্ধু সবার কাছে ফোন দিয়েছে । কর্নেল শাফায়াত ছুটে আসছিল। এটা তো কোনো সেনা অভ্যুত্থান ছিল না। বিপথগামী সেনা ও অবসরপ্রাপ্ত সেনারা এটা করেছিল। যখন তারা অস্ত্র নেয়, তখনই তাঁদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিত ছিল। শফিউল্লাহ এগিয়ে আসলো না।
কেন ওই দিন বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে শাফায়াত জামিলকে সঙ্গে নিয়ে পাঁচখানা, দশখানা ট্রাক আসে নাই। কীসের জন্য শফিউল্লাহ নীরব ছিল?’ বঙ্গবন্ধু শফিউল্লাহকে বলেছিলো তোমার সেনাবাহিনী আমার বাসায় আক্রমণ করছে তুমি ফোর্স পাঠাও জবাবে সফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন আপনি একটু বাসা থেকে বেরোয় যাইতে পারেন না। বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আর্মির ভয়ে বাসা থেকে পালায় না, আর তাঁর বানানো আর্মি দেখে উনি পালায় যাবেন। কেন সে দিন সফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুর বাসায় আসতে পারল না? মৃত্যু ভয়ে না কি অন্যকোন উদ্দেশ্যে।
এক অনুষ্ঠানে কে এম শফিউল্লাহের বলেন, আমি যখন জানতে পেরেছি কেউ আর জীবিত নেই, তখন সেখানে আমার যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। মৃত দেহ দেখে আমার কী লাভ হত? সফিউল্লাহ কি বঙ্গবন্ধু সহ ১৫ আগস্টের শহীদদের লাশ ভালোভাবে দাফন করার ব্যবস্থা করতে পারতে না ।
আওয়ামীলীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, কে এম শফিউল্লাহ যদি সময় মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতো, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানো যেতো।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে বঙ্গবন্ধুর ৪৩ তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভা বঙ্গবন্ধুর উপর ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জনকারী সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের সাথে রাজনৈতিক ব্যক্তি সাবেক আমলা ব্যবসায়ী জড়িত। গুটি কয়েক বিপদগামী সেনা সদস্য বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত এটা মিথ্যা কথা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান কেএম শফিউল্লাহ উপপ্রধান জিয়াউর রহমানসহ কম বেশি সকল সদস্য জানতেন। তারা দেশ প্রেমের পরিচয় দিলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারত না। খুনিরা জানত বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানো যাবে না। খুনি চক্র বাংলাদেশ কে পাকিস্তানের সাথে এক করতে চেয়েছিলো।
আদালত সফিউল্লাহকে কাপুরুষ আখ্যা দিয়েছে। খন্দকার মোস্তাকের প্রতি আনুগত্য পোষণ কারী শফিউল্লাহ রূপগঞ্জের সু সংগঠিত আওয়ামীলীগকে ধ্বংস করতে ভূমিদস্যুদের সাথে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করছে। আওয়ামীলীগকে ডুবানোর জন্য নানা গ্রুপিং করার চেষ্টা করছে। রূপগঞ্জ বাসি বঙ্গবন্ধু হত্যা কান্ডে সফিউল্লার নাটকীয় অবস্থানের জন্য তাকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সফিউল্লাহকে কাপুরুষ এবং তার জন্য রূপগঞ্জ বাসি লজ্জিত বলে বিভিন্ন ধরণের পোষ্ট দিচ্ছে। কেউ কেউ বলছে রূপগঞ্জের যারা সফিউল্লার সাথে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বাষিকী পালন করে তারাও আরেক খন্দকার মোশতাক।
জাতির পিতার হত্যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বিষাক্ত সাপের মতো ফণা তুলে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং দেশকে মুক্তিযুদ্ধের মহান আদর্শ ও চেতনা থেকে বিচ্যুত করার দিকে ঠেলে দেয়।
ঘাতকরা সে দিন শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই থেমে থাকে নি। বাঙালি জাতিকে নেতৃত্ব শূণ্য করতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হত্যা করে তার প্রিয় সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, তিন ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, সেনা কর্মকর্তা শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল এবং নবপরিণীতা দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। প্রবাসে থাকায় জীবন রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
নির্মম সেই হত্যাযজ্ঞে আরও নিহত হন বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, শিশু পুত্র সুকান্ত বাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, নিকটাত্মীয় শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন নিরাপত্তা কমকর্তা-কর্মচারী।
ইতিহাসের নির্মম সেই হত্যাকান্ডের বিচারের পথ বন্ধ করতে ইনডেমনিটি বিলও পাস করা হয় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। চলে ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র।